টাইফয়েড জ্বর হলে কি কি খাওয়া উচিত?

আপনি জানেন কি, আমাদের দেশে প্রতিদিন কত মানুষ টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হয়? হ্যাঁ, এই রোগটা আমাদের জন্য অনেক বড় একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে বর্ষাকাল কিংবা গরমে যখন পানি দূষিত হয়, তখন টাইফয়েডের প্রকোপ বেড়ে যায়। অনেকেই জানেন না, টাইফয়েড কীভাবে হয়, কী খেতে হয়, কিংবা এই জ্বরের সময় কী করলে উপকার পাওয়া যায়। আজকের এই লেখাটা আমি ঠিক সেভাবেই সাজিয়েছি — যেন আপনি আর আমি মুখোমুখি বসে কথা বলছি। সহজ ভাষায়, আমাদের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, চলুন জেনে নেই টাইফয়েড জ্বর নিয়ে বিস্তারিত।

টাইফয়েড জ্বর কি?

টাইফয়েড জ্বর একটি ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রামক রোগ। এই রোগটি “Salmonella Typhi” নামক ব্যাকটেরিয়ার কারণে হয়ে থাকে। সাধারণত এই জীবাণুটি দূষিত পানি ও খাবারের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করে। একবার শরীরে প্রবেশ করলে এটি রক্তের মাধ্যমে পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়ে এবং নানা উপসর্গ তৈরি করে। টাইফয়েড জ্বরের লক্ষণগুলো শুরুতে সাধারণ জ্বর, দুর্বলতা, মাথাব্যথা, পেটব্যথা কিংবা কোষ্ঠকাঠিন্য বা ডায়রিয়া দিয়ে শুরু হতে পারে।

এই রোগটি ধীরে ধীরে শরীরকে দুর্বল করে ফেলে এবং চিকিৎসা না করালে জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। টাইফয়েডে আক্রান্ত ব্যক্তি অনেক সময় এক সপ্তাহ বা তারও বেশি সময় জ্বর নিয়ে ভোগেন। আমাদের দেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে এই রোগের প্রকোপ বেশি, কারণ অনেক এলাকায় এখনও বিশুদ্ধ পানির অভাব, পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা নেই এবং স্যানিটেশন ব্যবস্থা দুর্বল।

সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হলো — টাইফয়েডের প্রাথমিক উপসর্গ অনেক সময় সাধারণ জ্বরের মতো লাগে, তাই অনেকেই গুরুত্ব দেন না। ফলাফল হিসেবে রোগটি আরও গভীরে গিয়ে মারাত্মক অবস্থায় পৌঁছে যায়। তবে ভালো খবর হচ্ছে, সচেতন হলে এবং ঠিক মতো চিকিৎসা নিলে টাইফয়েড পুরোপুরি নিরাময়যোগ্য। শুধু তাই না, টাইফয়েড হলে কী খাওয়া উচিত সেটাও কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সঠিক খাবার না খেলে সুস্থ হতে সময় আরও বেশি লাগে। তাই চলুন এবার জেনে নিই, টাইফয়েড জ্বর হলে কী ধরনের খাবার খাওয়া উচিত।

টাইফয়েড জ্বর হলে কি কি খাওয়া উচিত?

টাইফয়েড জ্বর হলে খাওয়া-দাওয়ার উপর সবচেয়ে বেশি নজর দিতে হয়। কারণ শরীর তখন খুব দুর্বল থাকে এবং হজমশক্তি অনেক কমে যায়। এই সময় এমন খাবার খেতে হবে যা সহজে হজম হয় এবং শরীরকে শক্তি দেয়।

সেদ্ধ ভাত ও ডাল

টাইফয়েড জ্বরের সময় সাদা সেদ্ধ ভাত ও পাতলা ডাল খাওয়া সবচেয়ে নিরাপদ। এই খাবারটি হজমে সহজ, পুষ্টিকর এবং শরীরকে প্রয়োজনীয় শক্তি জোগাতে সাহায্য করে। আমাদের দেশের ঘরে ঘরে এমন খাবার পাওয়া যায় বলেই এটি টাইফয়েড রোগীদের জন্য আদর্শ। ডালে থাকা প্রোটিন ও ফাইবার শরীরের কোষগুলোকে মেরামত করতে সাহায্য করে, আর সেদ্ধ ভাতে থাকা কার্বোহাইড্রেট দ্রুত এনার্জি দেয়। আপনি চাইলে সামান্য ঘি মিশিয়ে খেতে পারেন, তাতে স্বাদও বাড়ে এবং হজমে সুবিধা হয়। তবে ঝাল বা অতিরিক্ত লবণ না দেওয়াই ভালো। এই সময় ভাজা-পোড়া বা ঝাল খাবার পুরোপুরি এড়িয়ে চলুন।

স্যুপ

ভেজিটেবল স্যুপ বা চিকেন স্যুপ টাইফয়েডে খুব উপকারী। কারণ এতে একদিকে যেমন তরল আছে, তেমনি পুষ্টি উপাদানও প্রচুর। গাজর, পটোল, লাউ, আলু ইত্যাদি দিয়ে তৈরি এক বাটি স্যুপ শরীরকে হাইড্রেট রাখে এবং পেটেও আরাম দেয়। স্যুপে যদি হালকা করে আদা, রসুন দেওয়া হয়, তাহলে তা অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল কাজ করে। চিকেন স্যুপে থাকা প্রোটিন দুর্বল শরীরকে শক্তি দেয় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। একটানা স্যুপ খেতে বিরক্ত লাগলেও প্রতিদিন অন্তত একবেলা রাখলে উপকার পাওয়া যায়।

সেদ্ধ ডিম

ডিম আমাদের সবার কাছেই পরিচিত শক্তির উৎস। টাইফয়েডের সময় শক্ত কিছু খেতে না পারলেও সেদ্ধ ডিম খাওয়া যায়। ডিমে থাকা প্রোটিন শরীরের ক্ষতিগ্রস্ত কোষ পুনর্গঠন করে এবং দুর্বলতা দূর করে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, ডিম যেন ভালোভাবে সেদ্ধ হয় — আধা সেদ্ধ বা পোচ টাইপ না খাওয়াই ভালো। আপনি চাইলে ডিমের সাদা অংশ আলাদা করে খেতে পারেন, কারণ তাতে চর্বি কম থাকে। প্রতিদিন একটি করে ডিম খাওয়া টাইফয়েডে যথেষ্ট উপকারি হতে পারে।

খিচুড়ি

আমাদের দেশি খিচুড়ি টাইফয়েড রোগীর জন্য দারুণ একটি খাবার। হালকা তেলে রান্না করা পাতলা খিচুড়ি, যার মধ্যে চাল, ডাল, একটু সবজি এবং সামান্য মসলা থাকবে, তা সহজে হজম হয়। খিচুড়িতে থাকা উপাদানগুলো একসাথে শরীরকে দরকারি পুষ্টি দেয়। আপনি চাইলে এতে অল্প করে সেদ্ধ মুরগির মাংস মিশিয়ে নিতে পারেন। তবে তেল-মসলা বেশি যেন না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এমন খিচুড়ি টাইফয়েডের সময় শরীরকে পুষ্টি দেয়ার পাশাপাশি মনকেও শান্ত করে।

ফলের রস

তাজা ফলের রস টাইফয়েড রোগীদের জন্য খুব উপকারী। বিশেষ করে কমলা, আপেল, পেয়ারা কিংবা বেল — এগুলোর রস শরীরকে হাইড্রেট রাখে এবং ভিটামিন সি সরবরাহ করে। টাইফয়েডে যেহেতু অনেক সময় মুখের স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়, রস খেলে কিছুটা স্বস্তি পাওয়া যায়। তবে বাজারে কেনা বোতলের জুস নয়, বাসায় বানানো রসই খেতে হবে। চাইলে ছেঁকে নিয়ে খেতে পারেন, যাতে আঁশ কম থাকে এবং হজমে সহজ হয়। প্রতিদিন অন্তত একবার ফলের রস খেলে রোগমুক্তির গতি বাড়ে।

ওটস বা সুজি

টাইফয়েডের সময় হালকা খাবার খুব দরকার, আর ওটস কিংবা সুজি হতে পারে সেজন্য দারুণ বিকল্প। ওটসের মধ্যে আছে প্রচুর ফাইবার ও মিনারেল, যা হজমশক্তি ঠিক রাখতে সাহায্য করে। আবার সুজি (সুজির খিচুড়ি বা দুধে সুজি) দুধের পুষ্টি ও কার্বোহাইড্রেট একসাথে দিয়ে শক্তি দেয়। এই খাবারগুলো তরল আকারে নেওয়া যায়, তাই গলা বা পেটের সমস্যাও কম হয়। একবেলা যদি অন্য কিছু খেতে না পারেন, তাহলে এই খাবারগুলো সহজেই খেতে পারেন।

কলা ও পাকা পেঁপে

কলা এবং পাকা পেঁপে টাইফয়েডে খুবই উপকারী। কলা হজমে সাহায্য করে, গ্যাস কমায় এবং পটাশিয়াম সরবরাহ করে যা জ্বরের সময় দেহে পানিশূন্যতা রোধ করে। অন্যদিকে, পাকা পেঁপে হালকা, রিচ ইন ফাইবার, এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। পেঁপেতে থাকা এনজাইম খাবার হজমে সাহায্য করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য কমায়। এই দুটি ফল প্রতিদিন খাওয়া যেতে পারে — সকালে কিংবা বিকেলে হালকা কিছু খেতে ইচ্ছা করলে।

পর্যাপ্ত পানি ও ওআরএস

টাইফয়েডে ডায়রিয়া হলে শরীর থেকে প্রচুর পানি বেরিয়ে যায়। তাই প্রচুর পানি খেতে হবে। শুধু পানি নয়, সাথে ওআরএস (ওরাল রিহাইড্রেশন সলিউশন) খাওয়া উচিত। এটি শরীরের ইলেকট্রোলাইট ব্যালান্স ঠিক রাখে। চাইলে বাসায় লবণ-চিনি মিশিয়ে নিজেই ওআরএস বানাতে পারেন। দিনে অন্তত ২-৩ লিটার পানি পান করার চেষ্টা করতে হবে। পানি অবশ্যই ফুটানো বা ফিল্টার করা হতে হবে, যাতে নতুন করে জীবাণু না ঢোকে।

হালকা দুধ ও দই

অনেকেই টাইফয়েডে দুধ খেতে ভয় পান, কিন্তু হালকা দুধ খেলে বা পাতলা দুধ-চিনি মিশিয়ে খেলে উপকার হয়। এতে শক্তি পাওয়া যায় এবং শরীরের দুর্বলতা কিছুটা কমে। আবার দই খেলে অন্ত্রে ভালো ব্যাকটেরিয়া তৈরি হয়, যা হজমে সাহায্য করে এবং টাইফয়েডের ব্যাকটেরিয়ার সঙ্গে লড়াই করে। তবে কাঁচা দুধ নয়, ভালোভাবে ফুটানো দুধ বা ঠান্ডা দই খাওয়াই ভালো। যাদের দুধে অ্যালার্জি নেই, তারা টাইফয়েডে দিনে একবেলা দুধ নিতে পারেন।

বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন ও উত্তর সমূহ

“টাইফয়েড জ্বর হলে কি কি খাওয়া উচিত?” এই বিষয়ে আপনার মনে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে? তাহলে চলুন জেনে নেই সেই সকল প্রশ্ন ও উত্তরগুলো-

টাইফয়েড জ্বর কতদিন থাকে?

সাধারণত টাইফয়েড জ্বর ৭ থেকে ১৪ দিন পর্যন্ত থাকতে পারে। তবে ওষুধ ও খাবারে নিয়ম মেনে চললে এই সময় কমে আসে।

টাইফয়েড ছোঁয়াচে রোগ কি?

হ্যাঁ, টাইফয়েড ছোঁয়াচে। দূষিত খাবার বা পানির মাধ্যমে এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তিতে ছড়িয়ে পড়ে।

উপসংহার

টাইফয়েড জ্বর যদিও একটি জটিল রোগ, তবে সচেতন থাকলে এটি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, বিশুদ্ধ পানি, এবং সঠিক খাবার — এই তিনটি বিষয় ঠিক রাখলে অনেকটাই ঝুঁকি কমে যায়। টাইফয়েড হলে শুধু ওষুধে নয়, খাবারেই দ্রুত আরোগ্য নির্ভর করে। তাই সঠিক খাবার খাওয়া খুব জরুরি। আপনার পরিচিত কেউ যদি টাইফয়েডে ভোগেন, তাহলে তাকে এই খাবারগুলো সম্পর্কে জানিয়ে দিন। সচেতন হোন, সুস্থ থাকুন।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *