পাইলস হলে কি কি সমস্যা হয়?

আপনি কি কখনো পাইলস নামক সমস্যার কথা শুনেছেন? বাংলাদেশের অনেক মানুষ এই সমস্যায় ভুগলেও, লজ্জা বা সংকোচের কারণে কেউ খোলাখুলি বলতে চায় না। অথচ এটা খুবই সাধারণ একটি রোগ। আপনি, আমি কিংবা আমাদের আশপাশের যে কেউ এই সমস্যায় পড়তে পারি। তাই এই লেখাটি আমি খুব সহজ ভাষায় লিখছি যেন আপনি সহজে বুঝতে পারেন পাইলস আসলে কী, কেন হয়, কী সমস্যা হতে পারে এবং এর সমাধান কীভাবে সম্ভব।

পাইলস সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো জরুরি। কারণ, প্রাথমিক পর্যায়ে যদি আমরা এটা নিয়ে সচেতন হই, তাহলে খুব সহজেই চিকিৎসা করা যায়। কিন্তু অনেকেই দেরি করে ফেলেন, তখন সেটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। আজকের এই ব্লগে আমি আপনাদের সাথে একেবারে বন্ধুর মতো করে সব কিছু আলোচনা করবো।

পাইলস কি?

পাইলস, যেটাকে আমরা বাংলায় “অর্শ” বলি, এটা মূলত মলদ্বারের আশেপাশে রক্তবাহী শিরার ফোলাভাব। এই ফোলাভাব অনেক সময় মলত্যাগের সময় ব্যথা, রক্তপাত, অস্বস্তি বা জ্বালাপোড়া সৃষ্টি করে। পাইলস দুই ধরনের হতে পারে – বাহ্যিক (external) এবং অভ্যন্তরীণ (internal)।

বাহ্যিক পাইলস হলো মলদ্বারের বাইরে থাকা অংশে দেখা যায় এবং অনেক সময় এতে ব্যথা ও চুলকানি হতে পারে। অন্যদিকে, অভ্যন্তরীণ পাইলস হলো মলদ্বারের ভিতরের অংশে হয় এবং কখনো কখনো তা বাইরে বেরিয়ে আসতেও পারে, যেটাকে বলা হয় “prolapsed hemorrhoid”।

বাংলাদেশের আবহাওয়া, খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনযাত্রার ধরণ অনেক সময় এই রোগ হওয়ার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অনেকেই ঝাল খাওয়া, ফাইবারবিহীন খাবার গ্রহণ, কম পানি পান করা, দীর্ঘক্ষণ বসে থাকা কিংবা কোষ্ঠকাঠিন্যে ভোগার কারণে এই সমস্যায় পড়েন।

এটি কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়, এবং চাইলে খুব সহজেই lifestyle পরিবর্তনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তবে উপযুক্ত চিকিৎসা না করলে এটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা তৈরি করতে পারে।

পাইলস হলে কি কি সমস্যা হয়?

পাইলস হবার পর অনেকেই ভয় পান বা বিষয়টি লুকিয়ে রাখতে চান। কিন্তু সমস্যা না বললে বা বুঝে ব্যবস্থা না নিলে, তা দিন দিন বেড়েই চলে। পাইলস থেকে ছোট থেকে বড় নানা সমস্যা তৈরি হতে পারে। নিচে আমি আপনাকে দশটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে বলবো যেন আপনি নিজের শরীরের প্রতি আরও সচেতন হতে পারেন।

১. রক্তপাত

পাইলসের সবচেয়ে সাধারণ ও প্রথম দৃষ্টিগোচর সমস্যা হলো রক্তপাত। মলত্যাগের সময় টয়লেটে বা টিস্যুতে রক্ত দেখা যায়। অনেকেই ভাবেন এটি হয়তো কোনো সাময়িক ব্যাপার, কিন্তু বারবার হলে এটি অবশ্যই উদ্বেগের কারণ।

রক্তপাত সাধারণত অভ্যন্তরীণ পাইলস থেকে হয়। আপনি ব্যথা না পেলেও, যদি টয়লেটের সময় তাজা লাল রক্ত দেখতে পান তাহলে বুঝবেন এটি পাইলসের লক্ষণ হতে পারে। সময়মতো চিকিৎসা না নিলে এই রক্তক্ষরণ শরীরে আয়রন স্বল্পতা ও অ্যানিমিয়া তৈরি করতে পারে।

বাংলাদেশের অনেকেই প্রাথমিক পর্যায়ে একে অবহেলা করে থাকেন। অথচ, নিয়মিত পর্যবেক্ষণ আর ডাক্তারের পরামর্শে সহজেই এ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। দীর্ঘমেয়াদী রক্তপাত হলে শরীরে দুর্বলতা, মাথা ঘোরা এবং ক্লান্তিভাব দেখা দিতে পারে। তাই বিষয়টি একেবারেই অবহেলা করার মতো নয়।

২. ব্যথা ও অস্বস্তি

পাইলস থাকলে অনেক সময় তীব্র ব্যথা অনুভূত হয়, বিশেষ করে বাহ্যিক পাইলসে। বসা, হাঁটা বা কাজ করার সময় এটি কষ্টদায়ক হতে পারে। এই ব্যথা কখনো কখনো এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যাহত হয়।

ব্যথা সাধারণত পাইলসের ফোলা অংশে রক্ত জমাট বাঁধার কারণে হয়, যেটাকে বলা হয় “থ্রম্বোসড হেমোরয়েড”। এটি খুব যন্ত্রণাদায়ক এবং অনেক সময় শল্য চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।

পাইলসের ব্যথা সাধারণত রাতে বেশি হয় এবং মলত্যাগের পর ব্যথা বেড়ে যেতে পারে। অনেকেই এই ব্যথার কারণে খাবার কম খায় বা পানি পান বন্ধ করে দেয়, যা আরো বেশি কোষ্ঠকাঠিন্য তৈরি করে এবং পাইলস বাড়ায়।

৩. চুলকানি ও জ্বালাপোড়া

মলদ্বার এলাকায় তীব্র চুলকানি ও জ্বালাপোড়া অনুভব করা পাইলসের অন্যতম বিরক্তিকর উপসর্গ। বিশেষ করে গরমে বা ঘামে সমস্যা বেড়ে যায়। অনেকেই রাতে ঘুমোতে পারেন না এই কারণে।

এই সমস্যার পেছনে মলদ্বারে নিঃসৃত তরল, হালকা রক্তপাত বা ফোলা অংশে ঘর্ষণ দায়ী। পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় না রাখলে সমস্যা আরও বাড়ে। অনেকে ভুলবশত সাবান বা জীবাণুনাশক ব্যবহার করে আরও জ্বালা বাড়িয়ে ফেলেন।

এই সমস্যার সহজ সমাধান হলো নিয়মিত পরিষ্কার থাকা, হালকা কুল পানিতে ধোয়া এবং তুলতুলে টিস্যু ব্যবহার। তবে সমস্যাটা যদি নিয়মিত হয়, তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।

৪. কোষ্ঠকাঠিন্য

পাইলসের কারণে অনেকে কোষ্ঠকাঠিন্যে ভোগেন, আবার কোষ্ঠকাঠিন্য থেকেই পাইলসের শুরু হতে পারে। দুইটি যেন একে অপরের পরিপূরক সমস্যা। মলত্যাগে অতিরিক্ত চাপ দিলে পাইলস আরও খারাপ হতে পারে।

বাংলাদেশে অধিকাংশ মানুষই ফাইবারবিহীন খাদ্য গ্রহণ করেন, যেমন ভাজা-পোড়া, কম সবজি, কম পানি। এইসব কারণে পেট পরিষ্কার হয় না এবং প্রতিদিনের মলত্যাগ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে।

কোষ্ঠকাঠিন্য এড়াতে বেশি পানি পান, ফলমূল ও সবজি খাওয়া, নিয়মিত হাঁটা অত্যন্ত দরকারি। না হলে এটি শুধু পাইলসই নয়, আরও অন্যান্য পেটের সমস্যা তৈরি করে।

৫. ফোলা ও অস্বাভাবিক চাপ অনুভব করা

পাইলসের ফোলা অংশে চাপ পড়লে মনে হয় যেন কিছু একটা বেরিয়ে এসেছে বা চাপ দিচ্ছে। অনেক সময় বসা বা হাঁটার সময় অস্বাভাবিক অনুভব হয়।

এই চাপ ও অস্বস্তি কাজকর্মে প্রভাব ফেলে। অনেকে মনে করেন কিছু একটা মলদ্বার থেকে বের হয়ে আছে, এবং এটি নিজে নিজে ঢুকছে না। তখন অনেক সময় হাত দিয়ে চেপে ভিতরে ঢোকাতে হয়, যেটি কষ্টদায়ক ও অস্বাস্থ্যকর।

এই ধরনের পাইলসকে বলা হয় “গ্রেড ৩” বা “প্রোল্যাপসড হেমোরয়েড”, এবং চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। সচেতনতা না থাকলে এটি ধীরে ধীরে আরও জটিল হয়ে যায়।

৬. মলদ্বার থেকে বস্তু বেরিয়ে আসা

উন্নত স্তরের পাইলসে মলদ্বার থেকে ছোট টিউমারের মতো বস্তু বের হয়ে আসতে পারে। এটিকে অনেকে ভুল করে মনে করেন মাংসপিন্ড বা গজবস্তু, কিন্তু এটি আসলে ফোলা রক্তনালী।

এই বেরিয়ে আসা অংশ মলত্যাগের সময় দেখা যায় এবং কখনো কখনো নিজে থেকেই ভিতরে চলে যায়, আবার কখনো চাপে ভিতরে নিতে হয়। এতে সংক্রমণের আশঙ্কা তৈরি হয়।

এটি শারীরিক অস্বস্তি ছাড়াও মানসিক কষ্টও দেয়। রোগী নিজের শরীর নিয়ে লজ্জা ও দুশ্চিন্তায় ভোগেন, যা স্বাস্থ্যগতভাবে ক্ষতিকর।

৭. ইনফেকশন

পাইলস হলে যদি মলদ্বার পরিষ্কার না থাকে তাহলে খুব সহজেই ইনফেকশন হতে পারে। অনেক সময় খালি চোখে বোঝা না গেলেও, পুঁজ জমা বা তীব্র ব্যথা থেকে বোঝা যায়।

ইনফেকশন হলে মলদ্বারে পচন ধরার আশঙ্কা থাকে, এবং অনেক সময় সেখান থেকে জ্বর পর্যন্ত আসতে পারে। এটি সাধারণত উপেক্ষা করলে গুরুতর পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে।

ইনফেকশন হলে অবশ্যই ডাক্তার দেখাতে হবে। নিজে থেকে ঘরোয়া উপায়ে কিছু করলে উল্টো আরও বড় সমস্যা হতে পারে।

৮. টয়লেটের পর পরিষ্কার রাখতে অসুবিধা

পাইলসের কারণে অনেক সময় টয়লেটের পর পুরোপুরি পরিষ্কার হওয়া যায় না। কারণ পাইলসের ফোলা অংশে মল আটকে থাকে অথবা সেখানে রক্ত মেশে।

এতে দুর্গন্ধ, চুলকানি এবং অস্বস্তি বাড়ে। যারা অফিসে বা বাহিরে থাকেন, তাদের জন্য এটা খুবই অস্বস্তিকর একটি সমস্যা। অনেকে টয়লেটের পর বারবার পরিষ্কার করতে গিয়ে ঘষাঘষি করেন, যেটা ক্ষতিকর।

এই সমস্যা সমাধানে নরম টিস্যু, ওয়েট টিস্যু ব্যবহার এবং হালকা কুসুম গরম পানিতে ধোয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।

৯. মানসিক চাপ

পাইলস দীর্ঘদিন ধরে থাকলে মানসিক চাপও বেড়ে যায়। লজ্জা, অস্বস্তি এবং ব্যথা থেকে একজন মানুষ ধীরে ধীরে বিষণ্নতায় ভুগতে পারেন।

এমনকি ঘুমের সমস্যা, কাজের অনাগ্রহ এবং পরিবার-সামাজিক জীবনে দূরত্ব সৃষ্টি হতে পারে। বিশেষ করে যারা সামাজিক মেলামেশা বেশি করেন, তাদের জন্য এটা এক ধরণের মানসিক বন্দিত্ব।

এই মানসিক চাপ রোগটিকে আরও খারাপ করে তোলে, কারণ দুশ্চিন্তায় হজম খারাপ হয়, খাবার ঠিকমতো খাওয়া হয় না—ফলে পেট খারাপ ও পাইলস আরও বাড়ে।

১০. দৈনন্দিন জীবনে বিঘ্ন

পাইলস থাকলে স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা, খাওয়া-দাওয়া, অফিসে কাজ সব কিছুতেই বাধা আসে। ব্যথা, রক্তপাত, অস্বস্তি ও চুলকানি একসাথে হওয়ায় রোগী মানসিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়েন।

অনেকেই সকালে টয়লেটের সময় এত ব্যথা পান যে সারাদিন খারাপ কেটে যায়। আবার অনেকে হঠাৎ হঠাৎ রক্তপাতের কারণে বাইরে যেতে সংকোচ বোধ করেন। কেউ কেউ তো ভয়ে খাবারই কম খেতে শুরু করেন।

এই সমস্যাগুলো শুধু শারীরিক না, জীবনের মান এবং আনন্দ দুইকেই কমিয়ে দেয়। তাই সময় মতো সঠিক ব্যবস্থা না নিলে পুরো জীবনটাই দুর্বিষহ হয়ে যেতে পারে।

বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন ও উত্তর সমূহ

“পাইলস হলে কি কি সমস্যা হয়?” এই বিষয়ে আপনার মনে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে? তাহলে চলুন জেনে নেই সেই সকল প্রশ্ন ও উত্তরগুলো-

পাইলস কি শুধুই বয়স্কদের হয়?

না, পাইলস যেকোনো বয়সের মানুষের হতে পারে, বিশেষ করে যারা কোষ্ঠকাঠিন্যে ভোগে বা দীর্ঘক্ষণ বসে থাকেন।

পাইলস কি সারানো যায়?

হ্যাঁ, প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসা ও জীবনধারা পরিবর্তনের মাধ্যমে পাইলস সম্পূর্ণ সারানো সম্ভব।

উপসংহার

বন্ধুর মতো বলছি, পাইলস আসলে কোনো লজ্জার ব্যাপার নয়। এটা খুব সাধারণ এবং অনেক মানুষেরই হয়। যদি প্রাথমিক পর্যায়ে ব্যবস্থা নেওয়া যায়, তাহলে সহজেই নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। আপনাকে শুধু সচেতন থাকতে হবে, নিজের খাদ্যাভ্যাস, পানি পান, শারীরিক পরিশ্রম—এই কিছু অভ্যাস ঠিক রাখতে হবে।

যদি সমস্যা বেশি হয়, তাহলে অবশ্যই একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। সময়মতো ব্যবস্থা নিলে সার্জারির প্রয়োজনও পড়ে না। শরীর ও মন দুটোকেই ভালো রাখুন—এই চাওয়াই আমাদের সবার।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *