জন্ডিস হলে কি কি সমস্যা হয়?
আজকে আমরা এমন একটি স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে কথা বলবো যেটি আমাদের আশেপাশে প্রায়শই দেখা যায়—আর সেটি হলো “জন্ডিস”। এই রোগটি যতটা সাধারণ মনে হয়, বাস্তবে কিন্তু এটি অনেক জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে যদি সময়মতো চিকিৎসা না নেওয়া হয়। আমি আপনাদের সাথে আজকে খুব সহজভাবে, যেন বন্ধুর মতো গল্প করছি, সেইভাবে জন্ডিস সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো। চলুন তাহলে শুরু করি।
জন্ডিস কি?
জন্ডিস একধরনের শারীরিক লক্ষণ যা মূলত আমাদের শরীরে বিলিরুবিন নামক এক ধরনের রঙ্গক পদার্থের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কারণে হয়। বিলিরুবিন হলো এমন এক ধরনের পদার্থ, যা লিভার পুরনো রক্তকণিকা ভেঙে ফেলার পর তৈরি করে। সাধারণত লিভার এই বিলিরুবিন প্রস্রাব বা মলের মাধ্যমে শরীর থেকে বের করে দেয়। কিন্তু যখন কোনো কারণে লিভার ঠিকমতো কাজ করতে পারে না বা বিলিরুবিনের পরিমাণ বেড়ে যায়, তখন এই রঙটা আমাদের ত্বক, চোখ এবং নখে হলুদ আকারে দেখা যায়। এই হলুদ ভাবকেই আমরা জন্ডিস বলি।
জন্ডিস নিজে কোনো রোগ নয়, বরং এটি অন্য কোনো সমস্যার একটি উপসর্গ বা লক্ষণ। এর মানে হলো, আমাদের শরীরে অন্য কোনো সমস্যা হচ্ছে যার কারণে জন্ডিস দেখা দিচ্ছে। এটি শিশু, বড়, বৃদ্ধ—সব বয়সের মানুষের হতে পারে। তবে অনেক সময় বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এটি জন্মের কিছুদিন পর নিজে থেকেই চলে যায়। আর বড়দের ক্ষেত্রে অনেক সময় সিরিয়াস কিছু কারণের কারণে হয়, যেমন—লিভার সিরোসিস, হেপাটাইটিস, পিত্তনালী বন্ধ হওয়া ইত্যাদি।
জন্ডিস হলে কি কি সমস্যা হয়?
জন্ডিস হলে শরীরে অনেক ধরণের সমস্যা দেখা দিতে পারে, যা আপনার স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে অনেক কঠিন করে তুলতে পারে। নিচে আমরা একে একে সেই সমস্যাগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো, যেন আপনি সহজেই বুঝতে পারেন।
১. চুলকানি (Itching)
জন্ডিসের সবচেয়ে অস্বস্তিকর একটি উপসর্গ হলো চুলকানি। যখন লিভার থেকে বিলিরুবিন ঠিকমতো নির্গত না হয়ে রক্তে জমে যায়, তখন এই পদার্থটি ত্বকের নিচে জমা হতে থাকে। এই জমে থাকা পদার্থের কারণে ত্বকে তীব্র চুলকানি শুরু হয়। অনেক সময় এই চুলকানি এত বেশি হয় যে ঘুমানো পর্যন্ত কষ্টকর হয়ে পড়ে। কেউ কেউ এমনকি ত্বক ঘষে ঘষে ক্ষত করে ফেলেন। শরীরের বিভিন্ন অংশে, বিশেষ করে হাত, পা ও পিঠে বেশি চুলকানি হয়।
চুলকানির সঙ্গে সঙ্গে ত্বক খসখসে হয়ে যেতে পারে, এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে র্যাশ বা ফুসকুড়িও দেখা যায়। অনেকেই ভেবে নেন এটি এলার্জি বা চর্মরোগ, কিন্তু আসলে এটি জন্ডিসের ফলাফল। এ সমস্যা নিরসনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো মূল রোগটি অর্থাৎ জন্ডিস সঠিকভাবে চিকিৎসা করা। শুধু চুলকানির ওষুধ খেলে সাময়িক স্বস্তি মিললেও স্থায়ী সমাধান হয় না।
২. বমিভাব ও খাবারে অরুচি
জন্ডিস হলে অনেকেরই বমিভাব দেখা দেয় এবং খাওয়ার প্রতি একধরনের বিরক্তি চলে আসে। এ কারণে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। যেহেতু লিভার আমাদের হজম প্রক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ অংশ, তাই লিভার দুর্বল হলে হজমক্ষমতা কমে যায় এবং খেতে ইচ্ছা করে না। খাবারের স্বাদ ও গন্ধেও পরিবর্তন আসে।
কখনো কখনো খালি পেটে গা গুলিয়ে ওঠে, মাথা ঘোরে। কিছু খেলেই মনে হয় বমি চলে আসবে। এমনকি অনেকেই পানি খাওয়ার পরেও অস্বস্তি অনুভব করেন। এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে হলে সঠিক ডায়েট মেনে চলা খুব জরুরি। পানিজাতীয় খাবার এবং হালকা পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে। বেশি তেল-ঝাল এড়িয়ে চলা দরকার।
৩. প্রস্রাবের রং গাঢ় হয়ে যাওয়া
জন্ডিসের অন্যতম লক্ষণ হলো প্রস্রাবের রং পরিবর্তন। সাধারণত আমরা জানি, প্রচুর পানি খেলে প্রস্রাব স্বচ্ছ বা হালকা হলুদ হয়। কিন্তু জন্ডিস হলে তা গাঢ় হলুদ বা কখনো কখনো কমলা রঙের হয়ে যায়। এটি আসলে রক্তে বিলিরুবিনের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কারণে হয়।
অনেক সময় রোগী মনে করেন হয়তো পানির ঘাটতি বা ডিহাইড্রেশন হয়েছে, কিন্তু আসলে ভিতরে ভিতরে লিভার ঠিকমতো কাজ করছে না। চিকিৎসকরা এই প্রস্রাবের রং দেখে অনেক সময় জন্ডিস শনাক্ত করে থাকেন। তাই এমন কোনো পরিবর্তন হলে দেরি না করে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
৪. চোখ ও ত্বকে হলুদ ভাব
সবচেয়ে চেনা উপসর্গ হলো চোখ ও ত্বকের হলুদ রঙ। প্রথমে সাধারণত চোখের সাদা অংশে হলুদ ভাব দেখা যায়। এরপর সেটি ধীরে ধীরে চামড়ায় ছড়িয়ে পড়ে। কখনো কখনো নখের নিচেও এই হলুদ ভাব লক্ষ্য করা যায়।
এই হলুদ ভাব দেখে সাধারণ মানুষও বুঝে ফেলে যে এটি জন্ডিস হতে পারে। তবে অনেক সময় খুব কম মাত্রার হলে চোখে তেমন কিছু বোঝা যায় না। তখন রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হতে হয়। এই লক্ষণটি মূলত শরীরে বিলিরুবিন অতিরিক্ত মাত্রায় জমে যাওয়ার কারণে হয়, যা লিভার ঠিকমতো ফিল্টার করতে পারছে না।
৫. হজমে সমস্যা ও পেটে অস্বস্তি
লিভার আমাদের হজম প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। জন্ডিস হলে এটি দুর্বল হয়ে যায় এবং এর কাজ ঠিকভাবে সম্পন্ন করতে পারে না। ফলে গ্যাস, পেট ফাঁপা, বদহজম, ডায়রিয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্যের মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে।
অনেক সময় রোগীর পেটে ভার ভার ভাব হয়, খাবার ঠিকমতো হজম হয় না। এমনকি একবেলা খাবার খেলেও মনে হয় অনেক খেয়ে ফেলেছেন। এই ধরনের সমস্যা দীর্ঘদিন চললে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কমে যায়। তাই হজম সমস্যা হলে সেটি অবহেলা না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
৬. মল রঙ ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া
জন্ডিসে অনেক সময় রোগীর মলের রঙ ফ্যাকাশে বা সাদা ধরনের হয়ে যায়। এটি মূলত তখন হয় যখন লিভার থেকে পিত্তরস ঠিকমতো বের হতে পারে না এবং অন্ত্রে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়।
পিত্তরস মলকে স্বাভাবিক বাদামি রঙ দেয়। কিন্তু জন্ডিস হলে এই প্রক্রিয়া ব্যাহত হয় এবং মল স্বাভাবিক রঙ হারিয়ে ফেলে। অনেকেই এটা লক্ষ্য না করে ফেলেন, কিন্তু এটা জন্ডিসের এক গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ। তাই এমন হলে দ্রুত পরীক্ষা করানো উচিত।
৭. শারীরিক দুর্বলতা ও অবসাদ
জন্ডিস হলে শরীর খুব সহজেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে। রোগী কিছুক্ষণ হাঁটলেই বিশ্রাম নিতে চায়। মনে হয় শক্তি নেই, সব সময় শরীর ভারী ভারী লাগে। এই অবস্থা বিশেষ করে তখন বেশি হয় যখন জন্ডিস দীর্ঘস্থায়ী হয়ে যায়।
লিভার ঠিকমতো কাজ না করলে শরীরে টক্সিন জমে এবং রক্তে অক্সিজেন বহন ক্ষমতাও কমে যায়। এর ফলেই এই দুর্বলতা দেখা দেয়। এছাড়া খাবার না খাওয়ার কারণে শরীর পুষ্টিও পায় না। এ সময় বিশ্রাম নেওয়া, পর্যাপ্ত পানি পান এবং হালকা খাবার খাওয়া খুব জরুরি।
৮. জ্বর ও মাথাব্যথা
অনেক রোগীর ক্ষেত্রে জন্ডিসের সঙ্গে হালকা থেকে মাঝারি জ্বরও দেখা যায়। বিশেষ করে ভাইরাল হেপাটাইটিসের কারণে জন্ডিস হলে এই ধরনের উপসর্গ দেখা যায়। মাথাব্যথা, শরীর ব্যথা এবং মাঝে মাঝে ঠান্ডার অনুভূতি হয়।
এই জ্বর অনেক সময় সাধারণ ভাইরাসের মতো মনে হলেও আসলে এর পেছনে লিভার সমস্যা কাজ করে। তাই শরীরে কোনো ধরনের অস্বাভাবিক জ্বর বা মাথাব্যথা হলে সেটি হালকাভাবে না নিয়ে পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া উচিত।
৯. ওজন কমে যাওয়া
জন্ডিস হলে অনেক সময় শরীরের ওজন হঠাৎ করে কমতে থাকে। কারণ রোগী ঠিকমতো খেতে পারেন না, হজম হয় না, এবং দুর্বলতা বাড়তে থাকে। যেসব রোগীর জন্ডিস দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা অনেক বেশি দেখা যায়।
ওজন হ্রাস মানে শরীর ভেতর থেকে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। এতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, যা অন্যান্য রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। তাই জন্ডিস হলে শরীরের ওজন নজরে রাখা জরুরি এবং চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী খাদ্য তালিকা তৈরি করে নেওয়া উচিত।
১০. মানসিক চাপ ও বিষণ্ণতা
শরীর খারাপ হলে মনের ওপরও প্রভাব পড়ে, এটা স্বাভাবিক। তবে জন্ডিসে এটা একটু বেশিই হয়। অনেক সময় রোগী নিজেকে অসহায় মনে করেন, কাজ করতে পারেন না বলে হতাশ হয়ে পড়েন। দীর্ঘ সময় ধরে অসুস্থ থাকলে মনে নেতিবাচক চিন্তা ভর করে।
এটি কখনো কখনো বিষণ্ণতার দিকে নিয়ে যেতে পারে, বিশেষ করে যদি পরিবার বা আশেপাশের লোকজন সহযোগিতা না করেন। তাই জন্ডিসের সময় মানসিক সহায়তাও গুরুত্বপূর্ণ। ভালো গান শোনা, প্রিয় মানুষের সঙ্গে কথা বলা এবং ধৈর্য ধরা এখানে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন ও উত্তর সমূহ
“জন্ডিস হলে কি কি সমস্যা হয়?” এই বিষয়ে আপনার মনে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে? তাহলে চলুন জেনে নেই সেই সকল প্রশ্ন ও উত্তরগুলো-
জন্ডিস কি ছোঁয়াচে রোগ?
না, জন্ডিস নিজে ছোঁয়াচে নয়। তবে যদি হেপাটাইটিস ভাইরাসের কারণে হয়, তখন কিছু ধরনের হেপাটাইটিস (যেমন হেপাটাইটিস এ বা বি) ছড়াতে পারে।
জন্ডিস হলে কি ঘরোয়া চিকিৎসায় ভালো হওয়া যায়?
শুরুতে হালকা জন্ডিস হলে বিশ্রাম, তরল খাবার ও হালকা খাবারে কিছুটা উপশম মিললেও সঠিক চিকিৎসা ছাড়া পুরোপুরি ভালো হওয়া সম্ভব নয়। অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
উপসংহার
বন্ধুরা, আজকে আমরা জন্ডিস সম্পর্কে অনেক কিছু জানলাম। এই রোগটি খুব সাধারণ মনে হলেও, এটি শরীরের অনেক বড় ক্ষতি করতে পারে যদি সময়মতো সচেতন না হওয়া যায়। জন্ডিস হলে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, তবে অবহেলা করাও চলবে না। সঠিক সময়ে চিকিৎসা গ্রহণ, পুষ্টিকর খাবার খাওয়া, পর্যাপ্ত বিশ্রাম এবং পানি পান করলেই অনেকাংশে ভালো থাকা যায়। আপনার আশেপাশে কেউ জন্ডিসে ভুগলে তার পাশে থাকুন, সাহস দিন। নিজের শরীরের প্রতি যত্ন নিন, কারণ সুস্থ শরীরই আমাদের জীবনের মূল শক্তি।