ব্যাকটেরিয়া জনিত রোগের প্রতিকার সমূহ
আপনি নিশ্চয়ই “ব্যাকটেরিয়া” শব্দটা অনেকবার শুনেছেন। কিন্তু আপনি কি জানেন, এই ছোট ছোট জীবাণুগুলোই আমাদের জীবনে কত বড় প্রভাব ফেলে? প্রতিদিনের নানা সমস্যার পেছনে ব্যাকটেরিয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কেউ ব্যাকটেরিয়ার কারণে অসুস্থ হয়, কেউ আবার সঠিক প্রতিকার না জানার কারণে বিপদে পড়ে। আজ আমরা বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে সহজ ভাষায় জানব—ব্যাকটেরিয়া আসলে কী, এটি কীভাবে রোগ সৃষ্টি করে, এবং কীভাবে আমরা এসব রোগ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারি।
ব্যাকটেরিয়া কি?
ব্যাকটেরিয়া হলো এক প্রকার এককোষী অতি ক্ষুদ্র জীবাণু, যা খালি চোখে দেখা যায় না। পৃথিবীতে কোটি কোটি ব্যাকটেরিয়া রয়েছে—কিছু উপকারী, কিছু ক্ষতিকর। ব্যাকটেরিয়া এতই ছোট যে, এক ফোঁটা পানিতে হাজার হাজার ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে। এরা সাধারণত মাটি, পানি, বাতাস এবং জীবিত প্রাণীর শরীরে বসবাস করে।
সব ব্যাকটেরিয়া খারাপ নয়—আমাদের শরীরেও কিছু ভালো ব্যাকটেরিয়া থাকে, যেগুলো হজমে সাহায্য করে, রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে এবং পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখে। তবে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াগুলো সংক্রমণ ঘটায়, যেমন—জ্বর, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, যক্ষ্মা ইত্যাদি।
ব্যাকটেরিয়া দ্রুত গুণন করতে পারে। কিছু ব্যাকটেরিয়া এক ঘণ্টার মধ্যেই কয়েক লাখ সংখ্যায় পরিণত হতে পারে। এ কারণে একবার আক্রান্ত হলে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা দুর্বল থাকায় ব্যাকটেরিয়া-জনিত রোগ বেশি দেখা যায়। বিশুদ্ধ পানি, পরিচ্ছন্নতা এবং সচেতনতা না থাকলে এই সমস্যা আরও বেড়ে যায়।
বায়ুর মাধ্যমে, খাবারের মাধ্যমে, এমনকি কারও স্পর্শের মাধ্যমেও ব্যাকটেরিয়া ছড়াতে পারে। আর এ কারণে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যাকটেরিয়া সম্পর্কে জানা অত্যন্ত জরুরি।
ব্যাকটেরিয়া জনিত রোগের প্রতিকার সমূহ
আমরা অনেক সময় ব্যাকটেরিয়া-জনিত রোগে আক্রান্ত হই, কিন্তু কীভাবে তা প্রতিরোধ করব, সেই বিষয়ে অনেকেই জানি না। নিচে আমি কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিকার নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করছি, যা আপনাকে সচেতন করতে সাহায্য করবে।
পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা
ব্যাকটেরিয়া দূর করার প্রথম এবং সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো—পরিচ্ছন্নতা। প্রতিদিন হাত ধোয়া, রান্নার আগে এবং পরে হাত পরিষ্কার রাখা, সঠিকভাবে টয়লেট ব্যবহার করা এগুলো ব্যাকটেরিয়া থেকে রক্ষা পেতে সাহায্য করে। আমাদের দেশে অনেকেই এখনো সাবান দিয়ে হাত ধোয় না, বিশেষ করে গ্রামের দিকে। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, শুধুমাত্র সঠিকভাবে হাত ধোয়ার মাধ্যমেই ৭০% ব্যাকটেরিয়া-জনিত রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।
পরিষ্কার পানির ব্যবহার, বাসস্থান পরিচ্ছন্ন রাখা, বর্জ্য সঠিকভাবে ফেলা ইত্যাদি ছোট ছোট অভ্যাস গড়ে তুললেই আমরা নিজেদের ও পরিবারের সদস্যদের অনেক রোগ থেকে রক্ষা করতে পারি। স্কুলে পড়ুয়া শিশুদেরকেও শুরু থেকে এই অভ্যাস শেখাতে হবে।
বিশুদ্ধ পানি পান
বাংলাদেশে বিশুদ্ধ পানির সংকট এখনও অনেক এলাকায় রয়ে গেছে। অনেকেই নলকূপের পানি ফুটিয়ে না খেয়ে সরাসরি পান করেন। এতে টাইফয়েড, ডায়রিয়া, কলেরা ইত্যাদি ব্যাকটেরিয়া-জনিত রোগ হতে পারে।
পানি ফুটিয়ে খাওয়া, ফিল্টার ব্যবহার করা অথবা পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ব্যবহার করা একান্ত প্রয়োজন। চা বা রান্নায় ব্যবহৃত পানিও বিশুদ্ধ হওয়া দরকার। গ্রামের দিকে টিউবওয়েল থাকলেও অনেক সময় তা দূষিত হয়। সেগুলোর নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ জরুরি।
স্বাস্থ্যসম্মত খাবার গ্রহণ
অপরিষ্কার বা খোলা খাবার খেলে ব্যাকটেরিয়া শরীরে প্রবেশ করে নানা ধরনের সংক্রমণ ঘটায়। ফুটপাতের খাবার, বাসি খাবার, সঠিকভাবে রান্না না করা মাংস এসব ব্যাকটেরিয়া ছড়ানোর অন্যতম মাধ্যম।
নিয়মিত বাসায় রান্না করা তাজা খাবার খাওয়া, ফলমূল ধুয়ে খাওয়া, খাবার ঢেকে রাখা, ফ্রিজে সংরক্ষণ করা এসব অভ্যাস গড়ে তুললে সংক্রমণের সম্ভাবনা কমে।
পুষ্টিকর খাদ্য খাওয়া
শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য পুষ্টিকর খাবার খাওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দুর্বল শরীর ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করতে পারে না।
শাকসবজি, ফলমূল, ডিম, দুধ, মাছ ইত্যাদি নিয়মিত খাওয়া উচিত। বিশেষ করে শিশু, বৃদ্ধ এবং গর্ভবতী নারীদের পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিত করতে হবে।
অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে সচেতনতা
অনেকেই সর্দি-কাশি হলেই ফার্মেসি থেকে নিজের মতো অ্যান্টিবায়োটিক কিনে খান। এটি খুবই বিপজ্জনক। অ্যান্টিবায়োটিক যথাযথভাবে, চিকিৎসকের পরামর্শে না খেলে ব্যাকটেরিয়া আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। একে বলে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স।
এমনকি ভবিষ্যতে যখন আপনি গুরুতর অসুস্থ হবেন, তখন ওষুধ কাজ নাও করতে পারে। তাই সব সময় চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করুন এবং পূর্ণ কোর্স শেষ করুন।
টিকা গ্রহণ
ব্যাকটেরিয়া-জনিত অনেক রোগের বিরুদ্ধে এখন টিকা পাওয়া যায়, যেমন—টিটেনাস, ডিপথেরিয়া, টাইফয়েড ইত্যাদি। শিশুকাল থেকেই নিয়মিত টিকা নেওয়া হলে এসব রোগ অনেকটাই প্রতিরোধ করা যায়।
বাংলাদেশ সরকার ইপিআই (Expanded Programme on Immunization) এর মাধ্যমে বিভিন্ন টিকা প্রদান করে থাকে। অনেক মানুষ এখনো টিকার বিষয়ে সচেতন নয়। গ্রামের লোকজনদের মাঝে এই বিষয়ে প্রচার বাড়াতে হবে।
নিয়মিত চিকিৎসা সেবা গ্রহণ
অনেক সময় আমরা শরীরে অসুস্থতা অনুভব করলেও চিকিৎসা নিতে দেরি করি। বিশেষ করে গ্রামের দিকে মানুষ গুজব, ঝাড়ফুঁক, বা ওঝার ওপর নির্ভর করে। এতে রোগ জটিল হয়ে ওঠে।
ব্যাকটেরিয়া-জনিত রোগ প্রাথমিক অবস্থায় ধরতে পারলে তা সহজেই প্রতিকারের সুযোগ থাকে। তাই যেকোনো অস্বাভাবিক লক্ষণ দেখা দিলে নিকটস্থ হাসপাতালে যোগাযোগ করা উচিত।
স্বাস্থ্য শিক্ষা ও সচেতনতা
স্বাস্থ্য সম্পর্কে শিক্ষা থাকলে মানুষ অনেক রোগ প্রতিরোধ করতে পারে। স্কুল, কলেজ এবং মসজিদের মাধ্যমে স্বাস্থ্য শিক্ষা ছড়ানো যেতে পারে।
ব্যাকটেরিয়া কীভাবে ছড়ায়, কীভাবে তা প্রতিরোধ করা যায়—এসব বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য গণমাধ্যম ও সামাজিক প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করা উচিত।
খাদ্যপ্রক্রিয়াজাত প্রযুক্তি
বর্তমানে অনেক খাদ্য প্রক্রিয়াজাত করে বাজারে বিক্রি হয়। যদি এই প্রক্রিয়া সঠিকভাবে না হয়, তাহলে তা ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ায়।
অতএব খাদ্য প্রক্রিয়াজাত প্রতিষ্ঠানে মান নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশ স্বাস্থ্যকর রাখা, শ্রমিকদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা এসব বিষয় নিশ্চিত করতে হবে।
পরিবেশ দূষণ রোধ
ময়লা-আবর্জনা, পচা-বাসি খাবার ফেলা, খোলা নর্দমা এসব পরিবেশে ব্যাকটেরিয়া সহজেই জন্মাতে পারে। তাই আমাদের চারপাশের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখা দরকার।
কমিউনিটি উদ্যোগে ডাস্টবিন ব্যবহার, নিয়মিত পরিচ্ছন্নতা অভিযান, স্কুলে পরিচ্ছন্নতা শেখানো এসব শুরু করতে হবে আমাদের নিজেদের থেকেই।
বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন ও উত্তর সমূহ
“ব্যাকটেরিয়া জনিত রোগের প্রতিকার সমূহ” এই বিষয়ে আপনার মনে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে? তাহলে চলুন জেনে নেই সেই সকল প্রশ্ন ও উত্তরগুলো-
ব্যাকটেরিয়া কি শুধু ক্ষতিকর?
না, সব ব্যাকটেরিয়া ক্ষতিকর নয়। কিছু ব্যাকটেরিয়া আমাদের হজমে সাহায্য করে ও রোগ প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে।
ব্যাকটেরিয়া থেকে বাঁচতে কী সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ?
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং বিশুদ্ধ পানি পান ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকর উপায়।
উপসংহার
ব্যাকটেরিয়া খুব ছোট জীব হলেও এর প্রভাব অনেক বড়। বাংলাদেশে সচেতনতা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, স্বাস্থ্য শিক্ষা এবং সঠিক চিকিৎসা ব্যবস্থার মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়া-জনিত রোগ অনেকটাই প্রতিরোধ করা সম্ভব। আসুন, আমরা নিজেরা সচেতন হই এবং অন্যদেরও সচেতন করি। একটি সুস্থ, পরিচ্ছন্ন ও ব্যাকটেরিয়া-মুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলি।