কানে ঝিঁ ঝিঁ শব্দ দূর করার উপায়

আপনি কি কখনো অনুভব করেছেন, হঠাৎ কানে একধরনের তীক্ষ্ণ, শোঁ শোঁ বা ঝিঁ ঝিঁ শব্দ বাজছে, অথচ আপনার আশেপাশে কেউই সেটা শুনতে পাচ্ছে না? এটা একদমই অস্বাভাবিক কিছু নয়। অনেকেই জীবনের কোনো না কোনো সময় এমন সমস্যায় পড়েন। বাংলাদেশে বিশেষ করে বয়স্ক মানুষ, উচ্চ শব্দে কাজ করেন এমন মানুষ বা যাদের উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিস রয়েছে, তাদের মধ্যে এই সমস্যাটা বেশি দেখা যায়।

এই লেখাটা আমি লিখছি যেন আপনি সহজভাবে বুঝতে পারেন এই ‘ঝিঁ ঝিঁ শব্দ’ আসলে কী, কেন হয়, এবং কীভাবে আপনি এর থেকে মুক্তি পেতে পারেন। আমি চেষ্টা করবো যেন কথাবার্তার মতো আপনাকে বুঝিয়ে বলি, যেন মনে হয় আমরা একসাথে বসে আছি আর আমি আপনাকে এই বিষয়টা বুঝিয়ে দিচ্ছি।

ঝিঁ ঝিঁ শব্দ কি?

ঝিঁ ঝিঁ শব্দ বা ইংরেজিতে যেটাকে বলা হয় Tinnitus, এটা মূলত এক ধরনের কল্পিত শব্দ যা কেবল আপনি নিজেই শুনতে পান। এই শব্দটা কারো জন্য শোঁ শোঁ, কারো জন্য বি-বি করে বাজে, আবার অনেক সময় ইলেকট্রিক হামের মতও মনে হয়। আশেপাশে এই শব্দের কোনো উৎস না থাকলেও কানে অনবরত এই শব্দ বাজতে থাকে।

এটা আসলে রোগ নয়, বরং অন্য কোনো সমস্যার উপসর্গ। যেমন: কানে জমে থাকা ময়লা, কানের ভেতরের স্নায়ুতে ক্ষতি, উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রেস, অথবা এমনকি নির্দিষ্ট কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। কিছু ক্ষেত্রে এই শব্দ একটু পরে চলে যায়, আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে এটা স্থায়ীও হয়ে যেতে পারে। এজন্য অনেকেই ভয় পান, বিরক্ত হন, এমনকি ঘুমাতেও অসুবিধা হয়।

তবে চিন্তার কিছু নেই। এটা অনেক সময় নিজে থেকেই কমে যায়, আর কিছু কিছু উপায় অবলম্বন করলে আপনি অনেকটাই আরাম পেতে পারেন। আসুন তাহলে জেনে নেই কীভাবে এই অস্বস্তিকর ঝিঁ ঝিঁ শব্দ থেকে মুক্তি পাওয়া যেতে পারে।

কানে ঝিঁ ঝিঁ শব্দ দূর করার উপায়?

আমরা অনেক সময় ছোট সমস্যাকে অবহেলা করি, কিন্তু সেটাই এক সময় বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। ঝিঁ ঝিঁ শব্দের ক্ষেত্রেও তাই। এর পেছনে নানা কারণ থাকতে পারে, আর সেই অনুযায়ী সমাধানও হতে হবে নির্দিষ্টভাবে। নিচে আমরা এমন সাতটি কার্যকর উপায় নিয়ে কথা বলবো যেগুলো আপনাকে আরাম দিতে পারে।

১. কান পরিষ্কার রাখা

অনেক সময় কানে জমে থাকা ময়লা বা ইয়ার ওয়াক্স এই ঝিঁ ঝিঁ শব্দের প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ময়লা জমে গেলে সেটা কানের ভেতরের অংশে চাপ সৃষ্টি করে এবং শ্রবণক্ষমতা কমিয়ে দেয়। এর ফলে কানে অদ্ভুত শব্দ বাজতে শুরু করে। তাই প্রথমেই নিশ্চিত হতে হবে আপনার কান পরিষ্কার আছে কিনা।

অনেকেই নিজেরা ইয়ার বাড দিয়ে কান পরিষ্কার করেন, যা মোটেই নিরাপদ নয়। এতে করে কানের ভেতরের ময়লা আরও ভেতরে চলে যেতে পারে এবং কানের পর্দা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। সবচেয়ে ভালো হয় একজন অভিজ্ঞ ইএনটি ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে তার মাধ্যমে কানের ময়লা পরিষ্কার করানো। অনেক সময় শুধু এই কাজটাই যথেষ্ট হয় ঝিঁ ঝিঁ শব্দ দূর করতে।

তবে মনে রাখবেন, কান পরিষ্কার করার সময় যেন কোনো তেল বা কেমিক্যাল জাতীয় জিনিস ব্যবহার না করেন ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া। কারণ এগুলোর প্রতিক্রিয়াও কানের স্নায়ুতে প্রভাব ফেলতে পারে।

২. উচ্চ শব্দ থেকে দূরে থাকা

বাংলাদেশে আমরা অনেক সময়ই খুব উচ্চ শব্দে গান শুনি, বা বাজার, ট্রাফিক, মাইকিং ইত্যাদির আওয়াজে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। কিন্তু এই উচ্চ শব্দ আমাদের কানের ভেতরের সূক্ষ্ম স্নায়ু কোষগুলোকে ধ্বংস করে দিতে পারে, যা ঝিঁ ঝিঁ শব্দের জন্ম দেয়।

বিশেষ করে যারা ফ্যাক্টরি বা কন্সট্রাকশন সাইটে কাজ করেন, তাদের কানে সুরক্ষামূলক হেডফোন বা ইয়ারপ্লাগ ব্যবহার করা উচিত। বাসায় উচ্চ ভলিউমে গান শোনা, মোবাইলের হেডফোনে জোরে গান শোনা—এসব পরিহার করাই ভালো।

অতিরিক্ত শব্দ থেকে দূরে থাকা শুধু ঝিঁ ঝিঁ শব্দ কমাবে না, বরং আপনার শ্রবণ শক্তিকে দীর্ঘ সময় ভালো রাখবে।

৩. মানসিক চাপ কমানো

অনেক গবেষণায় দেখা গেছে, মানসিক চাপ বা স্ট্রেসও ঝিঁ ঝিঁ শব্দের অন্যতম কারণ হতে পারে। আমাদের মস্তিষ্ক যখন অতিরিক্ত চাপে থাকে, তখন তা আমাদের শ্রবণ স্নায়ুগুলোর উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। ফলে কানে বিভিন্ন রকম শব্দ শোনা যায়।

এই চাপ কমাতে মেডিটেশন, ধ্যান, গভীর শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম, অথবা হাঁটাহাঁটি অনেক কার্যকর। যারা নামাজ পড়েন, তাদের জন্য নামাজ নিজেই একটি মানসিক প্রশান্তির উপায়।

রাতে ভালো ঘুম, পর্যাপ্ত বিশ্রাম, এবং নির্দিষ্ট কিছু সময় নিজেকে রিল্যাক্স করার জন্য রাখা—এসবই সাহায্য করতে পারে কানে বাজা অদ্ভুত শব্দ কমাতে।

৪. সঠিক খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ করা

শরীরের প্রতিটি অঙ্গের মতো কানেরও ভালো যত্ন দরকার। অনেক সময় অতিরিক্ত চা-কফি, চর্বি যুক্ত খাবার, কিংবা প্রসেসড ফুডের কারণে শরীরে ব্লাড ফ্লো কমে যায়, যা কানের ভেতরের কোষগুলোকে ঠিকমতো অক্সিজেন সরবরাহে বাধা দেয়।

ফলমূল, শাকসবজি, ওমেগা-৩ যুক্ত মাছ (যেমন ইলিশ, রুই), বাদাম, এবং প্রচুর পানি পান করা কানের স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। পাশাপাশি লবণ খাওয়া নিয়ন্ত্রণে রাখলে রক্তচাপও ঠিক থাকে, যা ঝিঁ ঝিঁ শব্দ কমাতে সাহায্য করে।

৫. ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া

ঝিঁ ঝিঁ শব্দ যদি নিয়মিত বা স্থায়ী হয়, তাহলে দেরি না করে একজন ইএনটি (কান-নাক-গলা) বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত। কারণ এটা হয়তো কোনো বড় রোগের পূর্ব লক্ষণ হতে পারে—যেমন: শ্রবণ ক্ষমতা হ্রাস, স্নায়ুর রোগ, বা এমনকি টিউমার।

ডাক্তার আপনার কানের ভেতর পরীক্ষা করে দেখে নিতে পারেন ঠিক কোথা থেকে সমস্যা তৈরি হচ্ছে। তারা প্রয়োজনীয় মেডিসিন বা থেরাপি দিতে পারেন, যা আপনি নিজে থেকে বুঝে করতে পারবেন না।

৬. সাউন্ড থেরাপি বা হালকা শব্দ ব্যবহার

অনেক সময় কানে বাজা শব্দকে চাপা দিতে হালকা ও নিয়মিত শব্দ কাজে লাগে। একে বলা হয় সাউন্ড থেরাপি। যেমন ঘুমানোর সময় কোনো হালকা পাখার শব্দ বা বর্ষার শব্দ চালিয়ে রাখলে মস্তিষ্ক ওই ঝিঁ ঝিঁ শব্দকে গুরুত্ব দেওয়া কমিয়ে দেয়।

বাংলাদেশে এখন অনলাইনে বা মোবাইল অ্যাপে এমন অনেক হোয়াইট নোয়েজ বা ন্যাচারাল সাউন্ড পাওয়া যায় যা আপনি নিয়মিত শুনতে পারেন। এটা এক ধরনের ট্রেনিং মস্তিষ্কের জন্য—যাতে সেটা কানের শব্দটাকে ‘ignore’ করতে শেখে।

৭. হোমিওপ্যাথি বা বিকল্প চিকিৎসা

অনেকেই হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা পছন্দ করেন, কারণ এতে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম হয়। কিছু হোমিওপ্যাথিক ওষুধ আছে যেগুলো ঝিঁ ঝিঁ শব্দের ক্ষেত্রে কার্যকর বলে অনেকে দাবি করেন। তবে এটা একেক জনের জন্য একেক রকম কাজ করতে পারে।

এছাড়াও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা বা একিউপ্রেশার থেরাপিও অনেকের উপকারে এসেছে বলে জানা যায়। তবে এই বিকল্প চিকিৎসাগুলোর ক্ষেত্রেও একজন অভিজ্ঞ প্র্যাকটিশনারের পরামর্শ নেয়া খুব জরুরি।

বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন ও উত্তর সমূহ

“কানে ঝিঁ ঝিঁ শব্দ দূর করার উপায়?” এই বিষয়ে আপনার মনে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে? তাহলে চলুন জেনে নেই সেই সকল প্রশ্ন ও উত্তরগুলো-

ঝিঁ ঝিঁ শব্দ কি কানের দৃষ্টিতে মারাত্মক কোনো রোগ?

এটি সরাসরি কোনো রোগ নয়, তবে বড় সমস্যার উপসর্গ হতে পারে। তাই সময়মতো চিকিৎসা নেওয়া জরুরি।

এই শব্দ কি একেবারে ভালো হয়ে যায়?

অনেক ক্ষেত্রে সঠিক চিকিৎসা ও সচেতনতায় শব্দটি একেবারে দূর হয়ে যেতে পারে বা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।

উপসংহার

কানে ঝিঁ ঝিঁ শব্দ শুনে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, তবে অবহেলা করারও সুযোগ নেই। আপনি যত তাড়াতাড়ি বিষয়টা গুরুত্ব দিয়ে দেখবেন, তত তাড়াতাড়ি উপশম সম্ভব। আমাদের দেশের অনেকেই এটা নিয়ে চুপচাপ থেকে যান, কিন্তু আপনি তা করবেন না—নিজের যত্ন নিবেন, প্রয়োজনে ডাক্তারের কাছে যাবেন।

সবচেয়ে বড় কথা, নিজের শরীরকে ভালোবাসুন। আপনার কান যেমন গান শুনে আনন্দ দেয়, তেমনি সেটা ভালো রাখতে আপনার দায়িত্বও কিন্তু কম নয়। আশা করি এই লেখাটা পড়ে আপনি উপকৃত হয়েছেন এবং সামনে কেউ যদি এই সমস্যায় পড়ে, তাহলে তাকেও সাহায্য করতে পারবেন।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *