শ্বাসকষ্ট হলে কি কি খাওয়া যাবে না?

আজকে আমরা এমন একটি বিষয় নিয়ে কথা বলবো যা অনেকের জীবনের সঙ্গেই জড়িত—আর তা হলো শ্বাসকষ্ট। আমাদের চারপাশে অনেকেই আছেন যারা এই সমস্যায় ভোগেন, কিন্তু জানেন না কীভাবে খাবারদাবারের মাধ্যমে নিজেদের অবস্থা আরও খারাপ করে ফেলছেন। আপনি যদি শ্বাসকষ্টে ভোগেন, কিংবা আপনার পরিবারের কেউ এই সমস্যায় আক্রান্ত হন, তাহলে এই লেখাটি আপনার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চলুন একসাথে জানি, বুঝি, এবং সচেতন হই।

শ্বাসকষ্ট কি?

শ্বাসকষ্ট মানে হচ্ছে ঠিকভাবে শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া বা শ্বাসের গতি ও পরিমাণে সমস্যা হওয়া। অনেক সময় মনে হয় যেন বুকের মধ্যে কিছু আটকে আছে, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, বা গভীরভাবে শ্বাস নেয়া যাচ্ছে না। এই সমস্যাটি বিভিন্ন কারণে হতে পারে—যেমন হাঁপানি (Asthma), ব্রংকাইটিস (Bronchitis), নিউমোনিয়া, এমনকি হার্টের সমস্যার কারণেও শ্বাসকষ্ট হতে পারে। বাংলাদেশে ধুলাবালি, বায়ু দূষণ, ধূমপান, ঠাণ্ডা আবহাওয়া এবং নানা ধরণের অ্যালার্জির কারণে শ্বাসকষ্ট অনেক বেশি দেখা যায়।

শ্বাসকষ্টের সময় বুক ধড়ফড় করা, ঘন ঘন শ্বাস নেয়া, গলা বা বুক বেয়ে আওয়াজ বের হওয়া (যাকে হুইজিং বলা হয়), এমনকি ক্লান্তি বা মাথা ঘোরার মতো সমস্যাও দেখা দিতে পারে। ছোট শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ—সব বয়সের মানুষই এই সমস্যায় আক্রান্ত হতে পারেন। তবে সঠিক চিকিৎসা, সচেতনতা এবং খাবারদাবারের মাধ্যমে অনেকাংশে এই সমস্যাকে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।

শ্বাসকষ্ট হলে কি কি খাওয়া যাবে না?

যখন কারো শ্বাসকষ্ট থাকে, তখন অনেক খাবার আছে যা খাওয়া উচিত নয়, কারণ সেগুলো শ্বাসতন্ত্রে প্রদাহ বাড়িয়ে দেয় বা অ্যালার্জি তৈরি করে শ্বাস নেয়ার কষ্ট আরও বাড়িয়ে তোলে। আজকে আমরা এমন দশটি খাবার নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো যেগুলো শ্বাসকষ্ট থাকলে পরিহার করা উচিত।

১. দুগ্ধজাত খাবার

দুধ, দই, পনির বা মাখনের মতো দুগ্ধজাত খাবার অনেকের শরীরে অতিরিক্ত মিউকাস বা শ্লেষ্মা তৈরি করে। এই শ্লেষ্মা শ্বাসনালীতে জমে গিয়ে শ্বাস নিতে সমস্যা তৈরি করতে পারে। অনেক সময় মনে হবে যেন কিছু গলায় আটকে গেছে বা বুক ভারী হয়ে আছে। বিশেষ করে হাঁপানির রোগীদের ক্ষেত্রে এটি আরও মারাত্মক হয়ে ওঠে। যদিও সবাইকে প্রভাব ফেলে না, তবে যাদের দুধে অ্যালার্জি আছে বা যারা দুধ খেয়ে গলা ভারী অনুভব করেন, তাদের অবশ্যই এগুলো এড়িয়ে চলা উচিত। বাংলাদেশে গরমকালে দুধ বা মিষ্টি জাতীয় খাবার বেশি খাওয়া হয়, কিন্তু শ্বাসকষ্ট থাকলে তা নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি।

২. তেলেভাজা ও অতিরিক্ত মসলাদার খাবার

পুরি, সিঙ্গারা, চপ, এবং অতিরিক্ত ঝাল-মসলাযুক্ত খাবার যেমন কাচ্চি বিরিয়ানি বা তেহারি—এগুলো শরীরে গ্যাস্ট্রিক বা এসিডিটি বাড়ায়, যা শ্বাসতন্ত্রকে প্রভাবিত করে। গ্যাস্ট্রিক থেকে বুক জ্বালাপোড়া এবং এমনকি গলা পর্যন্ত টক ঢেকুর উঠে আসে, যা শ্বাসকষ্ট বাড়াতে পারে। এছাড়া অতিরিক্ত ঝাল খাবার শ্বাসনালীকে উত্তেজিত করে, ফলে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। অনেক সময় হাঁচি-কাশির মাত্রাও বেড়ে যায়। তাই এমন খাবার যতটা সম্ভব কম খাওয়াই ভালো।

৩. ঠান্ডা ও বরফযুক্ত পানীয়

শীতল পানীয়, আইসক্রিম, কিংবা ঠান্ডা দই—এগুলো অনেকের শরীরের প্রতিক্রিয়া হিসেবে শ্বাসনালিকে সংকুচিত করে তোলে। ফলে হঠাৎ করেই শ্বাসকষ্ট বেড়ে যেতে পারে। বিশেষ করে যাদের ঠাণ্ডাজনিত কারণে শ্বাসকষ্ট হয়, তাদের জন্য ঠান্ডা পানীয় বিপজ্জনক হতে পারে। অনেক সময় ঠান্ডা জিনিস খাওয়ার পর রাতে ঘুমাতে গিয়ে শ্বাস আটকে আসে। তাই ঠান্ডা বা বরফজাতীয় কিছু খাওয়ার আগে ভালোভাবে চিন্তা করা উচিত।

৪. প্রসেসড খাবার

চিপস, প্যাকেট বিস্কুট, ফাস্ট ফুড, এবং প্যাকেটজাত খাবারে প্রচুর পরিমাণে সংরক্ষণকারি, কৃত্রিম রঙ, এবং রাসায়নিক পদার্থ থাকে। এগুলো শরীরে অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে, যা শ্বাসতন্ত্রকে প্রভাবিত করে। এই ধরনের খাবার নিয়মিত খাওয়া মানে শরীরে বিষ জমে যাওয়া, যা ফুসফুসের কাজকে দুর্বল করে দেয়। বাংলাদেশে প্যাকেট খাবারের জনপ্রিয়তা বাড়লেও, শ্বাসকষ্ট থাকলে এসব এড়িয়ে চলা উচিত।

৫. গম বা গ্লুটেনযুক্ত খাবার

গম বা গ্লুটেন অনেকের জন্য অ্যালার্জির উৎস হতে পারে, বিশেষ করে যাদের শরীর গ্লুটেন হজমে অক্ষম। গ্লুটেন শরীরে ইনফ্লেমেশন বাড়ায়, যা শ্বাসনালীকে সংকুচিত করে দেয়। তাই যারা শ্বাসকষ্টে ভোগেন এবং গ্লুটেনে সংবেদনশীল, তাদের রুটি, বিস্কুট, পাউরুটি ইত্যাদি খাবার পরিহার করা উচিত। অনেক সময় নিজের অজান্তেই এই ধরনের খাবার শ্বাসকষ্ট বাড়িয়ে তোলে।

৬. লবণাক্ত খাবার

অতিরিক্ত লবণ খেলে শরীরে পানি জমে যায়, বিশেষ করে ফুসফুসে। এই পানি জমে শ্বাসকষ্টের কারণ হতে পারে। অনেক সময় দেখা যায় বয়স্কদের ক্ষেত্রে পা ফোলা বা বুকে ভার অনুভব হচ্ছে, যার কারণ অতিরিক্ত লবণ। তাই শ্বাসকষ্ট থাকলে খাবারে লবণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা উচিত।

৭. মাংসজাত ও প্রক্রিয়াজাত মাংস

সসেজ, সালামি, প্রক্রিয়াজাত গরু বা মুরগির মাংসে থাকা নাইট্রাইট এবং সালফাইট জাতীয় উপাদান শ্বাসনালীতে প্রদাহ বাড়াতে পারে। এগুলো শ্বাসকষ্টকে হঠাৎ করে বাড়িয়ে তোলে। বাংলাদেশে আজকাল এসব প্রক্রিয়াজাত খাবার জনপ্রিয় হচ্ছে, কিন্তু এগুলো শ্বাসতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর।

৮. চকলেট ও মিষ্টিজাত খাবার

চকলেটে থাকা কোকো ও চিনি অনেকের শরীরে অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। চিনি আবার শরীরের ইনফ্লেমেশন বাড়িয়ে তোলে, যা শ্বাসতন্ত্রে প্রভাব ফেলে। শিশুদের ক্ষেত্রে এটি আরও বেশি দেখা যায়। অতিরিক্ত মিষ্টি খাওয়া মানেই শ্বাসনালির ওপর বাড়তি চাপ দেওয়া।

৯. ডিম (বিশেষ করে কাঁচা বা আধসেদ্ধ)

অনেকের শরীরে ডিমের প্রতি অ্যালার্জি থাকে। কাঁচা বা আধসেদ্ধ ডিমে থাকা কিছু প্রোটিন শ্বাসতন্ত্রে হঠাৎ অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। কারও কারও ক্ষেত্রে গলা চুলকানো, হাঁচি বা কাশি দেখা দেয়, আবার কারও ক্ষেত্রে হঠাৎ করে শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়। ডিম খেলেও দেখে শুনে খাওয়া উচিত, বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে।

১০. ক্যাফেইনযুক্ত পানীয়

চা, কফি এবং এনার্জি ড্রিঙ্কে থাকা ক্যাফেইন শরীরের ডিহাইড্রেশন ঘটায়। ফলে শ্বাসনালী শুষ্ক হয়ে পড়ে এবং মিউকাস ঘন হয়ে যায়। এর ফলে শ্বাস নিতে আরও কষ্ট হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে চা-কফি সাময়িকভাবে ভালো লাগলেও, বেশি খেলে বিপদ ডেকে আনতে পারে।

বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন ও উত্তর সমূহ

“শ্বাসকষ্ট হলে কি কি খাওয়া যাবে না?” এই বিষয়ে আপনার মনে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে? তাহলে চলুন জেনে নেই সেই সকল প্রশ্ন ও উত্তরগুলো-

শ্বাসকষ্ট কি পুরোপুরি সারানো সম্ভব?

না, তবে নিয়মিত চিকিৎসা ও জীবনধারা পরিবর্তনের মাধ্যমে এটি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।

শিশুদের শ্বাসকষ্ট হলে কী করতে হবে?

শিশুর শ্বাসকষ্ট হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে এবং ঠান্ডা পরিবেশ ও খাবার থেকে তাকে দূরে রাখতে হবে।

উপসংহার

শ্বাসকষ্ট একটি অতি সাধারণ কিন্তু দুঃসহ সমস্যা, বিশেষ করে যারা দীর্ঘদিন ধরে এই সমস্যায় ভুগছেন। চিকিৎসা গ্রহণের পাশাপাশি প্রতিদিনের খাদ্যাভ্যাসেও সতর্কতা অবলম্বন করা অত্যন্ত জরুরি। ভুল খাবার শ্বাসকষ্ট বাড়িয়ে তুলতে পারে, আবার সঠিক খাবার শ্বাসকষ্ট নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। তাই আপনি যদি শ্বাসকষ্টে ভোগেন, তাহলে আজ থেকেই আপনার খাদ্যতালিকাটি একটু পরিবর্তন করুন। নিজে সচেতন হন, অন্যকেও সচেতন করুন।

সবচেয়ে বড় কথা, নিজের শরীরের প্রতিক্রিয়াগুলো বুঝে খাবার নির্বাচন করা উচিত। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করুন।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *