বাচ্চা পেটে আসলে কি কি সমস্যা হয়?
আপনি কি নতুন করে মা হওয়ার চিন্তা করছেন? অথবা হঠাৎ করেই জানতে পেরেছেন যে আপনি গর্ভবতী? যদি তাই হয়, তাহলে এটা আপনার জীবনের এক বড় পরিবর্তনের সময়। এই সময় অনেক প্রশ্ন, ভয় আর উত্তেজনা কাজ করতে পারে। শরীরে এবং মনে নানা পরিবর্তন আসতে পারে, যেগুলো স্বাভাবিক। তাই গর্ভধারণ সম্পর্কে ভালোভাবে জানা খুবই দরকার। আজকের লেখায় আমি খুব সহজভাবে আপনাদেরকে গর্ভধারণ, গর্ভাবস্থায় সমস্যাগুলো এবং কীভাবে এগুলো সামাল দিতে হয়, সেসব বিষয় নিয়ে বলব। আপনারা যেন বন্ধুর মতো পড়ে বুঝতে পারেন, সেই ভঙ্গিতে কথা বলছি।
গর্ভধারণ কি?
গর্ভধারণ হলো একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া, যেখানে একটি নারীর ডিম্বাণু পুরুষের শুক্রাণুর সাথে মিলিত হয়ে জরায়ুতে বসে যায় এবং সেখানে একটি নতুন প্রাণ বিকাশ শুরু করে। এটা ঘটে সাধারণত মাসিক চক্রের ডিম্বস্ফোটন (Ovulation) সময়ের পরে। গর্ভধারণ হওয়ার পর নারীর শরীরে হরমোনজনিত অনেক পরিবর্তন ঘটে, যার ফলে মাসিক বন্ধ হয়ে যায় এবং ধীরে ধীরে গর্ভে শিশু গঠিত হয়। গর্ভধারণ সাধারণত ৪০ সপ্তাহ বা ৯ মাস স্থায়ী হয়। এই সময়ের মধ্যে প্রতিটি ধাপই গুরুত্বপূর্ণ এবং যত্ন নেওয়া আবশ্যক।
গর্ভাবস্থায় নারীরা বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের মুখোমুখি হন, যেমন বমি বমি ভাব, ক্লান্তি, ক্ষুধা বেড়ে যাওয়া বা কমে যাওয়া, মনমরা ভাব ইত্যাদি। অনেকে আবার এই সময়টিকে তাদের জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময় বলে মনে করেন। তবে কিছু সমস্যাও দেখা দিতে পারে যেগুলো সম্পর্কে আগে থেকে জানলে মানসিক প্রস্তুতি নেওয়া সহজ হয়।
বাচ্চা পেটে আসলে কি কি সমস্যা হয়?
গর্ভাবস্থা মানেই শুধু আনন্দ নয়, কিছু শারীরিক এবং মানসিক চ্যালেঞ্জও আসে। কিছু সমস্যার কারণে দুশ্চিন্তা বাড়ে, আবার কিছু সমস্যার সমাধান খুব সহজেই করা যায়।
নিচে আমি ১০টি সাধারণ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করছি:
১. বমি বমি ভাব এবং বমি (মর্নিং সিকনেস)
গর্ভাবস্থার শুরুতেই অনেক মায়েরা এই সমস্যায় পড়েন। একে বলে “মর্নিং সিকনেস”, যদিও এটা শুধুমাত্র সকালে হয় না, সারাদিনই হতে পারে। এটি মূলত গর্ভাবস্থায় হরমোনের পরিবর্তনের কারণে ঘটে, বিশেষ করে হরমোন hCG বেড়ে যাওয়ার ফলে। অনেক সময় গন্ধে সহ্য না হওয়া, খাবারের স্বাদ পরিবর্তন, অল্পতেই বমি হয়ে যাওয়া এসব দেখা যায়। কেউ কেউ দিনে ৫-৬ বারও বমি করতে পারেন। এই সময় হালকা খাবার, আদা চা, প্রচুর পানি ও বিশ্রাম সহায়ক হতে পারে। তবে বমি যদি খুব বেশি হয় এবং শরীরে পানি কমে যায়, তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
২. মুড সুইংস বা মন পরিবর্তন
গর্ভাবস্থায় মনের পরিবর্তন খুবই সাধারণ। হঠাৎ করেই মন খারাপ হয়ে যাওয়া, কান্না চলে আসা, রেগে যাওয়া বা খুব হাসি পাওয়া – এসব হয় হরমোনের কারণে। এই সময় শরীরে ইস্ট্রোজেন এবং প্রোজেস্টেরনের মাত্রা বেড়ে যায়, যার প্রভাব পড়ে নারীর আবেগে। এই সময় পরিবার ও স্বামী/সঙ্গীর সহানুভূতি খুব দরকার। নিজের ভালো লাগার কাজ করা, হালকা গান শোনা বা বই পড়া মন ভালো রাখতে সাহায্য করে।
৩. ঘুমের সমস্যা
অনেক মায়েরা অভিযোগ করেন রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারেন না। কখনও পিঠে ব্যথা, কখনও পেটে চাপ, আবার কখনও বারবার প্রস্রাবের বেগ – এসব কারণে ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে। প্রথম এবং শেষ ট্রাইমেস্টারে এটা বেশি দেখা যায়। ঘুমানোর জন্য বাম দিকে কাত হয়ে শোয়া সবচেয়ে ভালো, এতে বাচ্চার দিকে রক্তপ্রবাহ ভালো থাকে। রাতে হালকা খাবার খাওয়া, চা-কফি এড়িয়ে চলা এবং আরামদায়ক বালিশ ব্যবহার উপকারী।
৪. হজমের সমস্যা ও অ্যাসিডিটি
বাচ্চা বড় হতে থাকলে পেটের মধ্যে চাপ বেড়ে যায়। ফলে পাকস্থলীতে থাকা এসিড উপরের দিকে উঠে আসে, যা বুকজ্বালা সৃষ্টি করে। আবার কোষ্ঠকাঠিন্যও দেখা দেয়। এই সমস্যা দূর করতে দিনে বারবার অল্প করে খাবার খেতে হবে, পানি বেশি খেতে হবে এবং আঁশযুক্ত খাবার খেতে হবে। কিছু ফল যেমন পাকা কলা, পেঁপে এগুলো হজমে সহায়তা করে।
৫. পিঠে ব্যথা
পেট বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরের ভারসাম্য বদলে যায়। পিঠে ও কোমরে চাপ পড়ে বেশি। বিশেষ করে দাঁড়িয়ে কাজ করলে বা ভারী কিছু তুললে এই ব্যথা বেড়ে যায়। নিয়মিত হালকা ব্যায়াম, সোজা হয়ে বসা ও হাঁটা, বেল্ট বা ব্যাক সাপোর্ট ব্যবহার করা এই সমস্যায় উপকারী।
৬. উচ্চ রক্তচাপ ও প্রি-এক্ল্যাম্পসিয়া
কিছু মায়েদের গর্ভাবস্থায় রক্তচাপ বেড়ে যেতে পারে, যাকে বলে গর্ভকালীন হাইপারটেনশন। এর সাথে যদি প্রস্রাবে প্রোটিন থাকে এবং শরীরে ফোলাভাব দেখা দেয়, তখন একে প্রি-এক্ল্যাম্পসিয়া বলে। এটি মারাত্মক হতে পারে। নিয়মিত রক্তচাপ পরীক্ষা করা, লবণ কম খাওয়া এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
৭. গর্ভকালীন ডায়াবেটিস
গর্ভাবস্থায় অনেক সময় রক্তে চিনির মাত্রা বেড়ে যায়, যাকে বলে জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস। এটি সাধারণত সাময়িক হয় তবে মা ও শিশুর জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। রক্তে চিনির মাত্রা নিয়মিত পরিমাপ করা, খাবারে নিয়ন্ত্রণ রাখা ও প্রয়োজনে ইনসুলিন নেওয়া জরুরি।
৮. অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধি
গর্ভাবস্থায় ওজন বাড়া স্বাভাবিক, তবে অতিরিক্ত ওজন বিভিন্ন জটিলতার কারণ হতে পারে। এটি গর্ভকালীন ডায়াবেটিস, হাই ব্লাড প্রেসার ও সিজারিয়ান সম্ভাবনা বাড়ায়। সঠিক খাদ্যাভ্যাস, ব্যায়াম এবং পর্যাপ্ত বিশ্রাম এই বিষয়ে সাহায্য করে।
৯. ত্বকে পরিবর্তন
গর্ভাবস্থায় অনেকের মুখে কালচে দাগ পড়ে (মেলাসমা), ত্বক শুষ্ক বা তৈলাক্ত হয়ে যেতে পারে। পেটেও চুলকানি বা দাগ দেখা দিতে পারে। এটি হরমোনজনিত কারণে হয়। পর্যাপ্ত পানি পান, ত্বকে ভালো ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার এবং সূর্য থেকে নিজেকে বাঁচানো এতে উপকারী।
১০. মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তা
শিশুর সুস্থতা, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, প্রসবের ভয় – এসব নিয়ে দুশ্চিন্তা হতেই পারে। তবে বেশি চিন্তা করলে তা মায়ের শরীর ও গর্ভস্থ শিশুর উপর প্রভাব ফেলতে পারে। তাই নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া জরুরি। প্রয়োজন হলে কাউন্সেলিং নেওয়া যেতে পারে।
বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন ও উত্তর সমূহ
“বাচ্চা পেটে আসলে কি কি সমস্যা হয়?” এই বিষয়ে আপনার মনে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে? তাহলে চলুন জেনে নেই সেই সকল প্রশ্ন ও উত্তরগুলো-
বাচ্চা পেটে আসার কতদিন পর গর্ভধারণ বোঝা যায়?
সাধারণত মাসিক মিস হওয়ার ১ সপ্তাহ পর গর্ভধারণ বোঝা যায়, এবং হোম প্রেগন্যান্সি কিটে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া যায়।
গর্ভাবস্থায় হালকা ব্যথা কি স্বাভাবিক?
হ্যাঁ, বাচ্চার বৃদ্ধি এবং শরীরের পরিবর্তনের কারণে হালকা ব্যথা অনেক সময় স্বাভাবিক, তবে তীব্র বা দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা হলে ডাক্তার দেখানো উচিত।
উপসংহার
গর্ভাবস্থা একটি সুন্দর সময়, তবে এতে কিছু সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ থাকতেই পারে। এগুলো থেকে ভয় পাওয়া বা লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। বরং সচেতনভাবে এগুলো মোকাবিলা করলে আপনি এবং আপনার বাচ্চা দুজনেই ভালো থাকবেন। নিয়মিত চিকিৎসকের কাছে যাওয়া, পরিবার ও স্বামীর সহযোগিতা, আর নিজের প্রতি ভালোবাসা – এ তিনটি জিনিস থাকলে আপনি খুব সুন্দরভাবে এই সময়টা পার করতে পারবেন। মনে রাখবেন, আপনি শুধু একজন মা নন, আপনি একজন যোদ্ধা!